গনগনে গনগনি
তারিখ এবং সময় দু’টোই অসাধারণ। তারিখ ২৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ আর সময় বিকেল ৩.৩০ মিনিট। আমরা পৌঁছে গেছি, যাকে বলে Grand Canyon of Bengal, সেখানে। জায়গার নাম গনগনি। অদ্ভুত নাম না! জায়গাটায় গেলেই বোঝা যায়, এ জায়গার নাম গনগনি ছাড়া আর কিছু হওয়ার ছিলো না।
গড়বেতা থেকে গনগনি
মেদীনিপুর জেলার গড়বেতা বলে একটি ছোট্ট শহরাঞ্চল থেকে ৩কিমি দূরত্বে এই গনগনি। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর সম্বন্ধে যাদের সামান্য ধারণা আছে তাঁরা নিশ্চয় জানেন এখানকার আবহাওয়া সম্পর্কে। যারা এখনো জানেন না তাঁদের বলি, মার্চ শুরু হল কি হল না, আমরা যখন পৌঁছালামা, সেই পড়ন্ত বিকেলে বাইরের তাপমাত্রা তখন ৩৫০ বই কম নয়। আমরা এসেছি নিজেদের চারচাকায় এবং এসি না চালিয়ে এগোতে পারিনি। তাতে কি, এসেছি তো প্রকৃতির বৈচিত্র্য উপভোগ করবো বলেই।

সেলুলয়েড মন ছেড়ে যখন গাড়ি থেকে বেড়োলাম, তখন আমরা একা নই; তিন চাকাওয়ালা অটোগাড়ি, রিক্সা, বাইক নিয়ে মানুষ ভীড় জমাচ্ছে একে-একে। এমন নয় যে এঁরা সবাই আমাদের মত টুরিস্ট, দেখলেই বোঝা যায় আঞ্চলিক মানুষের সংখ্যা বেশি। কাজের শেষে চলে আসেন নিয়ম অনিয়ম করে, প্রকৃতির বৈকালিক পারফরমেন্স দেখতে। প্রকৃতিও তৈরী তার প্রাত্যহিক লাইট এন্ড উইন্ড শো নিয়ে।
বৈঠকি গনগনি
সেই শো জমে ওঠার আগে আমরা নেমেই চট করে মুড়ি বাদাম ঠোঙ্গা ভোরে কিনে নিলাম। বাঙালী ইভনিং শো আয়েশ করে দেখবে, যেখানে আবার মাটির আদিম গন্ধ সেখানে মুড়ি মাখা না হলে আর কিসের বাঙালী হলাম! আর শো-এর ডিম্যান্ড আছে জেনেই রোজ যে এখানে কিছু মুড়ি-মাখা, বাদাম-মাখা, চা বিক্রেতেরা তাঁদের সরঞ্জাম নিয়ে সময় মত চলে আসেন, বেশ বোঝা যায়। প্রকৃতি এখানে পারফর্মেন্সের স্টেজটিও সাজিয়েছে বেশ সময় নিয়ে। মূল স্টেজের বিপরীতে অথবা এন্ট্রান্স বলা যেতে পারে যে জায়গাটাকে, সেখানে কাজু বাদামের বুনো গাছের আসর। বোঝা যায় কাজু বাদামের বন এই শো-এর সাক্ষী অনেক বছর থেকে ।

সেই গাছের সারি স্টেজের দিকে যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে মুড়ি-বাদাম, চা-ওয়ালারা বেশ সুযোগ বুঝে জায়গা করে নিয়েছেন। আবার প্রকৃতির সঙ্গে কোন সমঝোতা করে সরকার থেকে একটি মলিন গোল বৈঠকি জায়গাও করা আছে। প্রকৃতি তাকেও বেশ আপন করে নিয়েছে। প্রকৃতি যে মায়ের জাত, আপন – সে সবকিছুকে করে নিতে চায়, তা তাকে যতই আঘাত করো না কেন।

আমরা সেলুলয়েড দুই বান্ধবী গুটিগুটি মুড়ি হাতে, যে সিমেন্ট বাঁধানো দর্শকাসনেই আগে প্রলুব্ধ হবো – সে বোধকরি আঞ্চলিক মানুষ ও প্রকৃতি দু’জনেই মনে মনে জেনে রেখেছে। তাই ওই জায়গাটি আমাদের জন্য ফাঁকা পড়ে আছে। তো আমরাও কৃতজ্ঞ চিত্তে খবরের কাগজ বিছিয়ে শহুরেপনার পুরো নিদর্শন হিসেবে গুছিয়ে বসলাম। শো তখন ভিড়-কে আহ্বান করছে। সময় চারটের কাটা পার করেছে, আকাশ তার দিগন্তের কাছাকছি আগুন রঙা গনগনে কমলা রঙের সূর্য টিপ গুছিয়ে নিচ্ছে। সেই টিপের উজ্জ্বল ত্যাগী কমলা আলো ছড়িয়ে পড়ছে বাকী আকাশে, বাতাসে, শিলাই নদীর ক্লান্ত বুকে, তার হাতে খোঁদাই করা ভাস্কর্যে।

শিলাবতির ধারায় গনগনি
শিলাই নদী, ভালো নাম শিলাবতি। পুরুলিয়া জেলার ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে দৌঁড়ে চলে এসেছে বাঁকুড়া হয়ে পশ্চিম মেদিনিপুরে। লক্ষ্য তার দারকেশ্বর নদের প্রতি, ঘাটালের কাছে মাথা কুটেছে দারকেশ্বর নদের বুকে। মিলিত প্রেমের ধারার নাম দিয়েছে মানুষ রূপনারায়ণ। রূপনারায়ণ আবার গুটিগুটি গিয়ে হাত মিলিয়েছে হুগলী নদীতে। শিলাবতি অবশেষে মুক্তি পেয়েছে বঙ্গোপসাগরে – আর সব পশ্চিমবঙ্গীয় নদনদীর মতোই। শিলাবতি প্রতি বর্ষায় তার যৌবন ফিরে পায়, আর নিজের যৌবনের সৎ ব্যবহার অকৃপণ হৃদয়ে দুকূল ছাপিয়ে করে থাকে। সে যে তাঁর প্রথম যৌবন বয়স-গুলোতে কি কি তান্ডব করেছে তারই নমুনা এই গনগনি।
যৌবনের নেশায় বুঁদ শিলাবতি কোনকালে ধাড়ালো আঁচড় কেটেছে গনগনির নরম লাল পলিমাটিতে। শিলাকেটে অসাধারণ সব লাল মাটির ভাস্কর্য তৈরী করেছে অকৃতদার নির্জন গনগনির বুকে। তাই কি নদীর নাম শিলাবতি ? ফিচেল বাতাস এই নষ্টামির একমাত্র সঙ্গী। মিচকে ফুঁৎকারে মাটি ঝেড়ে পরিষ্কার করে রেখেছে শিলাবতির ভরা যৌবনের স্পর্শ। প্রকৃতি তার মাতৃত্ব দিয়ে এরপর বছর বছর আগলে রেখেছে তার বুকে ঘটে যাওয়া এই সব দুষ্টুমি। গনগনিও আর অকৃতদার নেই। তার খোয়াইয়ের দূরে-অদূরে জনবসতি দেখা যায়। আকাশ ভরা আলো যখন নরম হয়ে কমলা হয়ে আসে, তখন সেসব মানুষরাই চলে আসে শিলাবতির খোয়াইয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় একটু জিরিয়ে নিতে। আমরা দূর থেকে আসি শিলাবতির হাতে গড়া যৌবনের ভাস্কর্য দেখতে।

The Grand Canyon of Bengal
সময় ৫টার কাঁটা ছুঁতে চলেছে, বাতাস শুরু করেছে তার বক্তৃতা। সেই দাপটে আমাদের মুড়ির ঠোঙ্গা উড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা কমছে, এই সেই চরম মূহুর্ত, সূর্যের রঙ গাঢ় হয়ে এসেছে। সূর্যের গাঢ় আগুন রঙ্গে গনগন করছে শিলাবতির যৌবনের নিদর্শন গনগনি। লাল আলোয় আমরা দুই বান্ধবী মাতাল হয়ে ছুটলাম, এবার শিলাবতির ভাস্কর্যের ভিতরে যাব। নদী এখন খাঁদে, এসময় তার বৃদ্ধাকাল। সরকার তাই আমাদের মত দর্শকদের কথা ভেবে বুছি খাঁদের ধার বাঁধিয়ে, জায়গা মত ধাপেধাপে সিমেন্টের সিঁড়ি নামিয়ে দিয়েছে।

গনগনে আলো আমাদের ডাকছে। একছুটে ঢুকে গেলাম ভাস্কর্যের আনাচে-কানাচে। নদীর বাঁকে, শিলার ফাঁকে। বাতাসেরও বুঝি আনন্দের সীমা নেই। হাওয়ায় হাওয়ায় আমাদের সঙ্গ নিয়েছে। এ যেন কোন রাজমহল। কোথাও নৃত্যের মঞ্চ তো কোথাও মাটির পালঙ্ক। কোথাও মন্দির প্রাঙ্গণ, কোথাও কুঠুরি। ওই টুকু-তো জায়গা, তারই কত রূপ, কি রঙ! রঙে নেশা ধরে যায়।

আহা! ভরা পূর্ণিমায় না জানি প্রকৃতির এ প্রাসাদের কি রূপ। আমরা অনেকটা সময় নিরবে ধ্যানমগ্নের মত কাটালাম। নির্জন এ জায়গা, শুধু বাতাস, আলো, বৃদ্ধা নদী ও আমরা দু’জন বান্ধবী। ঘন্টাখানেকের জন্য আমরা ভুলে গেছিলাম আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব, আমাদের সংসার। প্রকৃতির চেয়ে বড় শিক্ষক কেউ হয়না। আমাদের নতুন করে শিখিয়ে দিলো, উত্থানের আনন্দ, পতনে স্থীরতা।

লাইট এন্ড উইন্ডের শো শেষের পথে। দিনের শেষে ক্লান্ত সূর্য পাটে বসেছেন, হাওয়াও বুঝি ক্লান্ত। নির্মল-মৃদু বইছে। আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে এলাম। সূর্য এবার বিদায় নিয়েছেন। যাওয়ার আগে একমুঠো আবির ছড়িয়ে গেছেন লাল মাটির দেশে, সবুজের মাথায় মাথায়। আসর ভাঙার পালা। আবির মেখে একে একে আমরা যে যার গন্তব্যের পথে …

~প্রিয়াঙ্কা বি
Very nice write up with excellent photographs taken.
Thank you, sir! Please stay with us.